All About Rabindra Sangeet

রবীন্দ্র সঙ্গীতের সব কিছু

Geetabitan.com (since 2008)

rabindranath and geetanjali
atmo jigyasar onno jagot (all part)
Author: Saurav Gangopadhyay

Rabindra Sangeet Albums. Sung by the verified singers of this website. 160 talented singers & over 850 songs.

Go to page

Rabindra Sangeet Collections. Sung by the verified singers of this website. Nearly 500 unique Tagore songs.

Go to page

Musical events organized by this website on the occasion of Pachishe Boishakh. In the year 2014 and 2015.

2014 2015

Detail information about Rabindra Sangeet. All the lyrics, notations, background history with detail musical compositions, English translation and many more.

Go to page

Rabindranath and Geetanjali

Atmo Jigyasar Onno Jagot

রবীন্দ্রনাথ ও গীতাঞ্জলিঃ আত্ম-জিজ্ঞাসার অন্য জগৎ

Author

Author: Saurav Gangopadhyay

A column, titled Rabindranath and Geetanjali, written by Saurav Gangopadhyay.

জন্ম: ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৯৫

শিক্ষা: এ কে ঘোষ মেমোরিয়াল স্কুল, পাঠভবন, প্রেসিডেন্সি কলেজ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। পরবর্তীতে শ্রীমতী সুচিত্রা মিত্রের তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা। রবিতীর্থ সঙ্গীত বিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতে স্নাতক। এরপরের শিক্ষা শ্রদ্ধেয়া শ্রীমতী মায়া সেনের কাছে। বর্তমানে ডঃ চিত্রলেখা চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষারত। উচ্চাঙ্গ কণ্ঠসঙ্গীতের তালিম পেয়েছেন শ্রী মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শ্রীমতী অরুন্ধুতী গুপ্তের কাছে। পঃবঃ রাজ্য সঙ্গীত একাদেমি, প্রদক্ষিণী এবং আনন্দধ্বনি আয়োজিত একাধিক সঙ্গীত-শিক্ষাক্রমে যোগদান করেছেন।

লেখালিখি: মূলত গবেষক-প্রাবন্ধিক। বিষয় প্রধানত রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসঙ্গীত। বেশ কিছুকাল বিশিষ্ট সঙ্গীত গবেষক-শিক্ষক সুভাষ চৌধুরীর গবেষণা-সহায়ক ছিলেন। লিখেছেন একালের রক্তকরবী, দলছুট, সুরের জগত, হান্দ্রেদ মাইলস, সাহিত্য দিশা, দেশ, মালিনী ইত্যাদি ছোটো-বড়ো পত্রিকায়। হান্দ্রেদ মাইলস পত্রিকার ২০১১ উৎসব সংখ্যার "সুচিত্রা মিত্র" বিষয়ক ক্রোড়পত্রের অতিথি সম্পাদক ছিলেন। জামশেদপুর টেগোর সোসাইটির রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন ২০১৪ উপলক্ষে প্রকাশিত পত্রিকার লেখকসূচীতে পবিত্র সরকার, সুধীর চক্রবর্তী, প্রমিতা মল্লিক প্রমুখের সঙ্গে আমন্ত্রিত লেখক ছিলেন। বাংলা উইকিপিডিয়া'র কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় সংক্রান্ত আলোচনা পত্রে "আনন্দধারা বহিছে ভুবনে" রবীন্দ্রসঙ্গীতটির সুর সংক্রান্ত বিতর্ক নিয়ে লেখকের আলোচনার উল্লেখ রয়েছে।

সঙ্গীত যাপন: যুক্ত আছেন "উত্তরায়ণ" সঙ্গীত গোষ্ঠীর সঙ্গে। নিজেও সঙ্গীতে শিক্ষকতা করেন। "গানের কবিতা, কবিতার গান", "রবীন্দ্রনাথের ভাঙ্গা গান", "ছয় ঋতু যে নৃত্যে মাতে" প্রভৃতি বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ক অনুষ্ঠানের পরিকল্পক ও ভাষ্য-রচয়িতা। ভারত সরকারের সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট এবং সৃষ্টি টি ভি চ্যানেলে রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ক একাধিক আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।

All parts in complete.

ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক দর্শন নিজেকে জানার কথা বলে। "আত্মানং বিদ্ধি" – উপনিষদের এই ঋষি বাণীই ভারতীয় জীবনচর্চার মূল সুর। কিন্তু নিজেকে চেনার নিজেকে জানার এই জিজ্ঞাসা – এ কি ভারতবর্ষীয় ঐতিহ্য-চিহ্নিত দার্শনিক তত্ত্বমাত্র? যদি আমরা কখন চেয়ে দেখি, আমাদের চারপাশের এই প্রাত্যহিক দিন যাপনের সংঘর্ষে ক্ষয়ে আসা ঘোলাটে জগৎটার দিকে, আহলে দেখব মূলতঃ ওই আত্মবোধের সংকটজাত প্রশ্নটাকে বুকে নিয়েই আমাদের চারিপাশের প্রতিটি মানুষ প্রতিনিয়ত তাড়িত হয়ে চলেছে। মানুষের যাবতীয় চিন্তাভাবনার মূলে রয়েছে তার নিজেকে জানার আতুর আকাঙ্ক্ষা। এই প্রসঙ্গে মনে আসে টমাস মান-এর সেই বিখ্যাত উক্তি – 'মানুষ যেদিন নিজেকে জেনে নিতে পারে আপনার সত্য স্বরূপে, সেদিনই সে হয়ে ওঠে এক অন্য সত্তা'। নিজের মধ্যে এই অন্য আমিকে খুঁজে নেওয়ার সাধনাতেই ছিল রবীন্দ্রনাথের আজীবনের পথ চলা। নিজের ভেতর এক স্বতন্ত্র আমিকে আবিষ্কার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর তাঁর বৃহত্তর জীবন বোধের ক্ষেত্রে এই ভেতরকার আমিই দেখা দিয়েছিল তাঁর জীবনদেবতার বেশে। "আমার নিগূঢ়তার মধ্যে যে একটি বৃহৎ অতিপুরাতন আমি আছে যে বিশেষরূপে আমার জীবনের দেবতা... আমি তাহাকেই ধরিয়া ফেলিবার চেষ্টায় উদয়াচল হাতড়াইয়া বেড়াইতেছি।" 'জীবনদেবতা'-র আলোয় নিজেকে জেনে নেওয়ার এই বাসনাই ব্যক্ত হয়েছিলো পর্ব থেকে পর্বান্তরে, কখনো গানে কখনো কবিতায়। -"তোমার মাঝে আমার আপনারে দেখতে দাও।"

'দেখে নেওয়ার' এই সাধনা শেষ হয়নি কোনদিন। জীবনযাত্রার এক এক স্তরে এক এক মূর্তিতে ধরা দিয়েছেন জীবনদেবতা। আকারে ইঙ্গিতে তাঁর 'নিগূঢ় আমি'-র ছায়া দেখেছেন কবি। তাই আপন হৃদয়-গহন-দ্বারে আজীবন কান পেতে থাকার পরেও ১৩২৯ সালের সেই গানে শুনি –

"কে সে মোর কেই বা জানে, কিছু তার দেখি আভা।
কিছু পাই অনুমানে, কিছু তার বুঝি না বা॥"

আমরা জানি – গীতাঞ্জলি রচনার যুগ স্পর্শ করে রয়েছে ১৩১৩ থেকে ১৩২১ বঙ্গাব্দ – রবীন্দ্রজীবনে অধ্যাত্মচেতনা বিকাশের তুঙ্গতম সময়টিকে। কিন্তু গীতাঞ্জলি কি কবির অধ্যাত্ম-আকুলতার কবিতা? আমরা যদি একটুখানি অন্য দিক থেকে দেখার চেষ্টা করি, তাহলে দেখব আধ্যাত্মিক আলোড়নের পাশাপাশি গীতাঞ্জলিতে কতখানি সত্য হয়ে উঠেছে, গীতাঞ্জলি রচনার তিন বছরের ব্যবধানে এন্ডরুজকে লেখা চিঠির সেই বিখ্যাত উক্তিটি – "আমার জীবনের সত্যিকারের উদ্দেশ্য একটাই... আমি যা তার ধ্যানরূপ সম্পূর্ণ হতে দেওয়া।" নিজের ধ্যানরূপকে সম্পূর্ণ করে তোলবার, আত্মসত্তার পূর্ণ বিকাশের এই সাধনার মধ্যেই গীতাঞ্জলীর অধ্যাত্ম ভাবনার মূল চাবিকাঠি। কেননা রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্ম জগতের ভিত্তিতে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর জীবনদেবতার কল্পনা। আর আগেই বলেছি যে জীবনদেবতা নানান রূপে নানান বেশে কবির জীবনে বারে বারে দেখা দিয়েছেন আলোছায়ার লুকোচুরি খেলায়, তিনি আসলে কবির নিগূঢ়তার সেই 'অতিপুরাতন' আমি। তাই রবীন্দ্র চেতনায় আত্ম-অন্বেষণের ধারাপথটিকে যদি আমরা অনুসরণ করি তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সে পথ আমাদের পৌঁছে দেবে দৈনন্দিন গতানুগতিকতার বহু ঊর্দ্ধে, এক অন্য ভাবলোকে।

গীতাঞ্জলি সম্পর্কে একদা লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন – "এ কেবলমাত্র আমার নিজের মনের কথা, আমারই প্রয়োজনে লেখা।" নিঃসংশয়ে গীতাঞ্জলিকে বলা যায় একপ্রকারের স্বগত কথন। আর সে অর্থে দেখতে গেলে যে কোন গীতি-কবিতাই তো রচিত হয় কবির ব্যক্তিগত আত্মচারণের তাগিদ থেকে। কিন্তু যে ভেতরকার আমি-কে জানতে কবির এই আতুর প্রয়াস সেই 'নিগূঢ়তার আমি' কি বহির্পৃথিবীর হাসি-কান্না, বিরোধ-বিদ্বেষ, আনন্দ-বিষাদ, সমস্ত কিছুর থেকে বিচ্ছিন্ন, স্বতন্ত্র কোন সত্তা? মনোজগতের সেই অতল গহনকে কি স্পর্শ করে না সমাজের উত্তাপ? একটু ভেবে দেখলেই মনে হয় যে তা সম্ভব ছিল না কোনদিন। রবীন্দ্রনাথ চিরজীবন নিজেকে দেখতে চেয়েছিলেন এই বিশ্বসংসারের আলো-ছায়ার মাঝে থেকেই। আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণের মাঝেখানেই তিনি পাততে ছেয়েছিলেন আপন আসন। তাই অসীম কালের যে হিল্লোলে, জোয়ার-ভাঁটায় ভুবন দুলেছিলো, নিজের নাড়ীতে রক্তধারায় তারই টান অনুভব করেন কবি। নিজের নিগূঢ়তমকেও উদ্ভিন্ন হতে দেখেন জগৎ সংসারের বিপুল বৈচিত্রের মাঝে। জীবনদেবতা – রবীন্দ্রনাথের এই কল্পনার সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্টই হল এই যে – আপন গূঢ়তম প্রদেশে কবি যে সত্তার অনুভব, নিখিল বিশ্বের হাসি কান্না ভরা সমস্ত ওঠা পড়ার মধ্যে তাঁরই রূপান্তর যেন ধরা পড়ে কবির চোখে। একদা 'চিত্রা'-য় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন –

"জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে
তুমি বিচিত্ররূপিণী।
... ... ... ...
অন্তরমাঝে তুমি শুধু একা একাকী অন্তরব্যাপিনী॥"

তাঁর জীবনদেবতা-ভাবনায় এর চেয়ে বড়ো সত্য আর কিছু নেই। নিজেকে নিজের মধ্যে রেখে নয়, সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেবার মধ্যেই নিজের নিগূঢ়তার পরিপূর্ণ বিকাশসাধন, আত্মসত্তার পূর্ণ নির্মাণ – রবীন্দ্রচেতনার ভাবলোকে চিরকালের "সকল বাণীর সার" এই সত্য গীতাঞ্জলির যুগে এক নুতনতর আঙ্গিকে মূর্ত হল। অন্তরতমের সঙ্গে কবির যোগ – সেখানে বিশ্বসাথে, একযোগে –

"বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো॥"

পৃথিবীর সকল দেশের প্রায় সকল কবির সঙ্গে তাঁদের দেবতার নিবিড় নৈকট্যের সম্পর্ক আমরা দেখি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দেবতা একান্তভাবে অবস্থানগত কারণেই আর সকলের চেয়ে বিশিষ্ট। আলোচনার গোড়াতেই যে কথার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলাম – নিজেকে গড়ে তোলবার সাধনা – সে হয়তো কবি-জীবনের কোন একটি বিশেষ পর্যায়ের উপলব্ধি। তবে জীবনদেবতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের যে ধারাবাহিকতা তার ইতিহাসকে যদি পর্যালোচনা করে দেখতে চাই, তাহলে দেখব এ সাধনার বীজ নিহিত ছিল জীবনদেবতা কল্পনার প্রতিটি পর্বের কবি চেতনাতেই। প্রকৃতপক্ষে জীবনদেবতা বোধ রবীন্দ্রনাথের জীবনে একটা ধারাবাহিক সত্যের উদ্ভাস। কবির জীবনে তাঁর জীবনদেবতা প্রকাশ পেয়েছিলেন একটা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। আর এই বিবর্তনের ধারায় রবীন্দ্রনাথ আসলে দেখে নিতে চেয়েছিলেন নিজেকেই। জীবনদেবতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিচিত্রতা আসলে তাঁরই একটা বিচিত্রমুখী প্রকাশকে ফুটিয়ে তোলে। জীবনদেবতা তাই কবির জীবনে কখনো 'পিতা', কখনো 'মিতা', কখনো 'আপন সখার মতো', আবার কখনো 'জীবনস্বামী'-র রূপে ধরা দেন।তাঁর এই রূপ থেকে রূপান্তরে এগিয়ে চলা যে কোন একটি বিশেষ কালের বিশেষ কোন এক পরিকল্পনা জাত – এমন কথা মনে করার কোন কারণ নেই। কালের যাত্রায় জীবনপথের এক একটি বাঁক যেমন উপস্থিত হয়েছে কবির সামনে কবি নিজেকে ঠিক তেমন তেমন ভাবেই উপস্থাপিত করেছেন তাঁর জীবনদেবতার কাছে। আসলে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন নিজেরই সামনে। বলা যেতে পারে কবির নিজেকে চিনতে চাওয়ার, জানতে চাওয়ার এক মাধ্যম এই জীবনদেবতা। লক্ষ্য করলে দেখা যায় কবির জীবনের ওঠাপড়া কিভাবে ছাপ রেখে গিয়েছে সমসময়ের জীবনদেবতা রূপে, কবির সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধচিত্রণে। তাই কবি তাঁর জীবনদেবতার সঙ্গে কখনো ডুব দিয়েছেন বিশুদ্ধ রোমান্টিকতার অতল গহনে, কখনো বাস্তবের প্রখর রৌদ্রালোকিত মাটিতে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছেন সংসারের তাপ। আবার কখনো সে সম্পর্ক হয়ে উঠেছে কোন মানবিক ভাষা – অভিধার নাগাল না পাওয়া এক অনির্বচনীয়ের বাঞ্জনায় স্নিগ্ধ। গীতাঞ্জলি এই তৃতীয় যুগেরই কাব্য। এ যুগের জীবনদেবতার স্বরূপ, এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের প্রকৃতি – বর্তমান পরিসরে এই হবে আমাদের আলোচ্য।

গীতাঞ্জলির যুগে (গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-গীতালি) অসংখ্য গানে কবিতায় কোন এক 'তুমি' সম্বোধিত হয়েছে বারবার। "আজ আমি যে বসে আছি তোমারই আশ্বাসে", "কবে আমি বাহির হলেম তোমারই গান গেয়ে", "ওদের কথায় ধাঁদা লাগে, তোমার কথা আমি বুঝি" প্রভৃতি পংক্তি তার সাক্ষ্য বহন করছে। প্রশ্ন হচ্ছে – কে এই 'তুমি'? ইনিই কি কবির জীবনদেবতা? গীতাঞ্জলির অসংখ্য গানে এই 'তুমির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেহারাটা আভাসিত দেখি। আবার গীতাঞ্জলিতেই এমন বহু গানের সন্ধান মেলে যেখানে দেখি রবীন্দ্রনাথের এই 'তুমি' হয়ে উঠেছেন বিশ্বজগতের। রবীন্দ্রনাথ নিজেই যাকে চিহ্নিত করেছেন "ত্রিভুবনেশ্বর" বলে।

'দেখে নেওয়ার' এই সাধনা শেষ হয়নি কোনদিন। জীবনযাত্রার এক এক স্তরে এক এক মূর্তিতে ধরা দিয়েছেন জীবনদেবতা। আকারে ইঙ্গিতে তাঁর 'নিগূঢ় আমি'-র ছায়া দেখেছেন কবি। তাই আপন হৃদয়-গহন-দ্বারে আজীবন কান পেতে থাকার পরেও ১৩২৯ সালের সেই গানে শুনি –

"আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে॥"

কবি নিজের একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কের পাত্রটিকে যে খুঁজে নিতে চাইছেন বিশ্বদেবতার মাঝে। প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের প্রথাবদ্ধ গণ্ডিতে পরিমাপ হয় না – এই হল রবীন্দ্রনাথের দেবত্ব কল্পনার, ঈশ্বর-ভাবনার বিশেষত্ব। গীতাঞ্জলির যুগের এই যে ঈশ্বর, ইনি বিশ্বদেবতা। অথচ এরই মাঝে নিজের জীবনদেবতাকে দেখে নেওয়ার কবির যে প্রয়াস সে আমাদের চোখে জন্ম দিল এমন এক অধ্যাত্মলোকের যেখানে ঈশ্বর, মানুষ, প্রকৃতি মিলে গিয়ে জন্ম নিয়েছে এর ত্রিবেণীধারার নিরন্তর প্রবাহ। - "মানুষ ও ঈশ্বরকে বষ্টন করে অধ্যাত্মভাবনায় কেন্দ্রিত গীতাঞ্জলি-ত্রয়ীর ভাবজগৎ।"

'চিত্রা-চৈতালী' বা তৎপূর্ববর্ত্তী যুগপর্যায়ে যখন রবীন্দ্রনাথ রচনা করে চলেছেন একের পর এক ব্রহ্মসঙ্গীত, সেখানে পাচ্ছি কোন এক 'রাজরাজ' 'বিশ্বরাজ'-এর কথা। কিন্তু সমকালের জীবনদেবতার সঙ্গে বা কবির অন্তরতমের সঙ্গে তাঁর ঠিক প্রকৃতিগত মিল আমরা যেন পাই না। চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সে যুগের জীবনদেবতা সম্বন্ধে নিজেই বলেছেন "ধর্মশাস্ত্রে যাহাকে ঈশ্বর বলে তিনি বিশ্বলোকের, আমি তাঁহার কথা বলি নাই। ... যিনি আমার এবং আমি যাঁহার ... চিত্রা কাব্যে – তাঁহারই কথা আছে" এই জীবনদেবতা ঠিক ঈশ্বর নন। বলা যায় কবির 'গভীর গোপনে' প্রদোষের ছায়ান্ধকারে ইনি এক 'আধফুট' স্বপনবিহারী, এক অদ্ভুত রোমান্টিকতার মায়াবরণে আবৃত। কিন্তু সে মায়াবরণটা কেটে গেল যেদিন "জীবনের রণক্ষেত্রে / দিকে দিকে জেগে উঠল সংগ্রামের সংঘাত / গুরু গুরু মেঘমন্দ্রে।" সামাজিক সাংসারিক নানা উপপ্লবে মৃত্যুশোকের অভিঘাতে বিশ-শতকের গোড়ায় রবীন্দ্র-জীবনে যে বাত্যাবিক্ষোভ জন্ম নিয়েছিল, সমসময়ের অন্তর্লোক হয়তো তারই ফলশ্রুতিতে অন্তরতমের আসনটা পাতা হয়ে যাচ্ছিল "বিশ্বরাজ্য মাঝে"। 'নৈবেদ্য'-র যুগের দেবতা, তিনি উপনিষদে বর্ণিত ঈশ্বর – দুঃখরাতে অন্ধকারে আসেন রণগুরুর মতো, পিতৃবেশে। গীতাঞ্জলির যুগে যিনি এলেন, তিনিও ঈশ্বর, কিন্তু রোমান্টিকতার মধুর আবেষ্টনের তাঁর আবির্ভাব। বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে, শ্রাবণঘনগহন মোহে কবির চিত্তদুয়ারে যাঁর আবির্ভাব, তিনিও দেবতা, কিন্তু তিনি কবির 'প্রিয়তম'। গীতাঞ্জলির সঙ্গে 'নৈবেদ্য'-র ফারাকটা এইখানে। গীতাঞ্জলির যুগে এসে রবীন্দ্রচেতনায় পূজা ও প্রেমের সমান্তরাল দুটি ধারা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথে জীবনদেবতা আসলে এই বিশ্বের দেবতারই এক অন্যতর বিচিত্র প্রকাশ। কবির জীবনে জীবনদেবতার উদ্ভব তাঁর অধ্যাত্মবোধের উৎস থেকেই। এই জীবনদেবতার আবির্ভাবেই কবি হয়ে ওঠেন 'দেবতাত্মা'। আপন নিগূঢ়তার এই 'আমি'-র যোগেই ঈশ্বরের সঙ্গে কবির যোগ। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেন – 'তাহার সহিত প্রেমের আনন্দে যুক্ত হইয়া পরস্পরকে সম্পূর্ণ করিয়া তুলিতে পারিলে তবেই অতিজগতের সহিত জগতের নিত্য প্রেমের সম্বন্ধ আপনার মধ্যেই বুঝিতে পারিব।' অনিবার্যভাবেই আমাদের মনে পড়ে যায় নীটশের কথা, যিনি মানুষকে দেখেছিলেন অবমানব আর অতিমানবের মধ্যবর্ত্তী এক সেতু রূপে। নীটশের মানবিক সাধনার লক্ষ্যই ছিল নিজে কোন পরিণাম না হয়ে, নিজের মধ্যে বৃহত্তর এক পরিণামকে অর্জন করা। রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতার কল্পনায়, বিশেষতঃ গীতাঞ্জলির যুগে পাশ্চাত্য দর্শনের এই তত্ত্বের এক অন্যতর প্রকাশকেই আমরা লক্ষ্য করি। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায় টম্পসনের রবীন্দ্রজীবনীর উক্তি – "He found a deep and intimate communication with God into which Jivandebata feeling merged."

পাশ্চাত্যের অস্তিত্ববাদী দর্শন বলে নিজেকে চিনে নেওয়ার মানবিক আকাঙ্ক্ষার জন্য দুঃখরাতের অন্ধকারের মানুষ যখন পৌঁছে যায় বিভ্রান্তির শেষ সীমানায়, যখন আর কোন পথ বাকী থাকে না, তখনই সে ঝাঁপ দেয় আপন অধ্যাত্মলোকের গহনে। নিজের ধ্যানরূপকে সম্পূর্ণ হতে দেওয়ার যে সাধনলক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত স্থির ছিল রবীন্দ্রজীবন, এই পরিপূর্ণ আত্মনিবেদনের মধ্য দিয়েই তার এক সুস্পষ্ট প্রকাশ গীতাঞ্জলির যুগে –

"আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।
সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥"

Soren Kierkegaard বোধহয় এই আত্মনিবেদনকেই চিহ্নিত করেন "the existentialist leap to faith." বলে। গীতাঞ্জলির এই আত্মসত্তার স্বরূপাবিষ্কারের সাধনাকে আমরা অনায়াসে তাঁর ভাষায় বলতে পারি "a total personal confrontation". এ যেন আত্মচেতনার এক নগ্ন সম্মুখীনতা। আত্মসন্ধানী মানুষের যে তিন অস্তিত্বের কথা Kierkegaard-এর দর্শনে আমরা পাই তারই সূত্র ধরে গীতাঞ্জলির অধ্যাত্ম সাধনাকে বলা যায় "...leap from … subjective self-assertion to self surrender by the shock of despair." যে "দ্বন্দ্বের দুঃখ, বিপ্লবের আলোড়ন" এ ছেয়ে রয়েছে নৈবেদ্য'র কালপর্ব, তারই পরিণতিতে গীতাঞ্জলির সাধনার শুরু। এ সাধনা এক পরিপুর্ণ আত্মনিবেদনের মধ্যে আপন ধ্যানরূপসম্পূর্ণতার সাধনা।

"গীতাঞ্জলি থেকে গীতালি" আত্মসন্ধানের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের এ এক অন্যতর আত্মপ্রতিষ্ঠার যুগ। গীতাঞ্জলির আদ্যন্ত আচ্ছন্ন করে রয়েছে এক ঐশ্বরিক চেতনার নির্যাস। আধুনিক কালের এক সমালোচক মন্তব্য করেছেন, গীতাঞ্জলি কবির সঙ্গে তাঁর দেবতার নিভৃত কিছু সংলাপের কবিতা। আসলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা প্রায় সকলেই প্রায়শই সত্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চলি কিছু ঝাপসা অনিশ্চিতের আকর্ষণে। গীতাঞ্জলি রবীন্দ্রনাথের "শান্তিময় বৈরাগ্যের মাঝে জগতের নিগূঢ় সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার স্বরূপাবিষ্কার" এর কবিতা। এই স্বরূপাবিষ্কারই রচনা করেছে গীতাঞ্জলির ঐশ্বরিক পরিমণ্ডল। যে আমি-তুমির সংলাপে ভরে রয়েছে গীতাঞ্জলি থেকে গীতালির যুগপর্ব, সে আসলে রবীন্দ্রনাথের আত্মচেতনারই দ্বৈধ – অনেকটা যেন 'split personality'-র মতো। শ্লেগেল একদা বলেছিলেন, আমরা যখন ভাবি, অধিকাংশ সময়ই আমরা তখন কথা বলি নিজেদের সঙ্গে। স্পষ্টতঃই আমাদের চেতনায় তখন জন্ম নেয় দুটো সত্তা। আত্মসত্তায় এই আমি-তুমির দ্বৈধ কল্পনা শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, দেশে দেশে কালে কালে অসংখ্য ভাবুক ধ্যানী মানুষদের মধ্যেই পেয়ে থাকি। একে তাঁরা দিয়েছেন এক ঈশ্বর ভাবুকতার মূর্তি। সে অর্থে গীতাঞ্জলিকে রবীন্দ্রনাথে ঐশ্বরিক চেতনার কবিতা বললে খুব ভুল বলা হবে না।

ডঃ সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত গীতাঞ্জলির যুগ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছিলেন "গীতাঞ্জলিতে একটি সুর খুব বেশী করিয়া ফুটিয়াছে; তাহা হইতেছে একান্ত আত্মবিলোপের সুর।" কিন্তু সত্যিই কি গীতাঞ্জলিকে আমিত্ব বিলোপের কবিতা বলা চলে? কোন সন্দেহ নেই গীতাঞ্জলি রবীন্দ্রনাথের নিজেকে কোন এক পরমের কাছে সঁপে দেওয়ার গান। কিন্তু নিজেকে বিলিয়ে দিয়েও কবির সত্তা তো আত্মসচেতনতা হারায় নি। তাঁর জগতের কেন্দ্রে নিজের স্থান সম্পর্কে কব প্রত্যয়ভূয়িষ্ঠ। কবির ঘরের আঁধারটুকু দূর হলেই সফল হবে এই আকাশজোড়া তারার আলো। কবির জীবনের দেবতা জন্ম-জন্মান্তর ধরে মিলতে চেয়েছেন শুধু তাঁরই সঙ্গে। -

"আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে!"

এরই সমান্তরালভাবে গীতাঞ্জলিতেই পাই –

"তাই তোমার আনন্দ আমার'পর
তুমি তাই এসেছ নীচে –
আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে॥"

গীতিমাল্যের গানে বলেছেন –

"তুমি যে চেয়ে আছ আকাশ ভ'রে,
নিশিদিন অনিমেষে দেখছ মোরে॥
আমি চোখ এই আলোকে মেলব যবে
তোমার ওই চেয়ে-দেখা সফল হবে,
এ আকাশ দিন গুনিছ তারি তরে॥"

জীবনদেবতার সঙ্গে একযোগে মিলতে পারলেই কবির জীবনে সব আনন্দের সার্থকতা।

"তোমার আমার মিলন হলে
সকল যায় খুলে –
বিশ্বসাগর ঢেউ খেলায়ে
উঠে তখন দুলে।"

কবির জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যও জীবনদেবতার লীলাকেই সার্থক করে তোলা –

"আমার মাঝে তোমার লীলা হবে
তাইতো আমি এসেছি এ ভবে॥"

গীতাঞ্জলি নিজের দেবতার সঙ্গে কবির এক যুগল লীলার কাব্য। সেখানে ন্যূন নয় কেউ। উভয়েই উভয়ের মহিমায় সমুজ্জ্বল।

"তাই তো, প্রভু যেথায় এল নেমে
তোমারি প্রেম ভক্তপ্রাণের প্রেমে
মূর্তি তোমার যুগলসম্মিলনে
সেথায় পূর্ণ প্রকাশিছে॥"

গীতাঞ্জলি থেকে গীতিমাল্য হয়ে গীতালি, আত্মসত্তার পূর্ণ বিকাশের লক্ষ্যে এই যে কবির মানসযাত্রা সে যেন ধীরে ধীরে এসে পরিসমাপ্তি পেয়েছে প্রশান্ত গভীর এক অনুভবের মাঝে। 'পরিসমাপ্তি' কথাটার ব্যবহার হয়তো সংগত নয়, কেননা এর পরবর্ত্তী যুগেই বলাকার হাত ধরে রবীন্দ্রনাথের আত্মজিজ্ঞাসা পৌঁছবে এক অন্য জগতে। আসলে এতো এক নিরন্তর প্রবাহ। কিন্তু তবু বলতে পারি জাগতিক বিরোধ সংক্ষোভের দিনে নিজের জীবনের দেবতা চিনতে চাওয়ার আতুর প্রয়াস গীতালিতে এসে একটা কুলে মিলতে পেরেছিল। কবি অনুভব করেছিলেন, সুখের দিনে যার হাসি "আলোকে ঢেলে পড়ে" দুঃখরজনীর বেদনার দান তাঁরই। সেই হৃদয়বিহারী বেদনায় জীবনের পেয়ালা ভরে তুলতে পারলেই পরমপ্রিয় ধরা দেবেন অনুভূতির গভীরে। তাই গীতালিতে এসে শুনি কবির প্রত্যয়ভুয়িষ্ঠ কণ্ঠস্বর –

"অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো,
সেই তো তোমার আলো॥"

ডঃ উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে,"গীতালিতে আসিয়াই কবির অধ্যাত্মজীবন শেষ পরিণতি লাভ করিল। খেয়ার আকুল আকাঙক্ষা ও প্রতীক্ষা, গীতাঞ্জলির হতাশা ও বিরহ-বেদনা, গীতিমাল্যের যুগল প্রেমলীলা ও বিরহানুভুতি - গীতালিতে পরিপূর্ণ উপলব্ধি ও আত্মসমর্পনে সার্থকতা লাভ করিল।"

"আমার জীবনে নিরন্তর ভিতরে একটি সাধনা ধরে রাখতে হয়েছে। সে সাধনা হচ্ছে আবরণ মোচনের সাধনা।" গীতাঞ্জলি শুধু নিজেকে গড়ে নেওয়ার গান নয়, গীতাঞ্জলি রবীন্দ্রনাথের সেই আবরণ মোচনের সাধনা। প্রতিদিনকার ছোট বড় সাংসারিক নানা ঘটনার আবর্তের মধ্য দিয়ে যে 'আমি'-কে আমরা বয়ে বেড়াই সে আমি গ্লানিময়, Kierkegaard - এর ভাষায়"ভাঙা-ছেঁড়া"। কিন্তু তার বাইরে শিলার সেই যে বলেছিলেন এক আদর্শ মানুষের সম্ভাবনার কথা, কিংবা এমার্সনের 'active soul', যে মিশে আছে প্রতিটি মানব সত্তায়, রবীন্দ্রনাথ তাকেই ধরতে চেয়েছিলেন। ভেলরির ভাষায় বলতে গেলে, এ এক অন্যতর জাগরণের সাধনা। কীটস, শেলী, ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ এমনকি টেনিসন প্রতীচ্যের রোমান্টিকতার এই সব শীর্ষপুরুষদের লেখায় বারবার করে যে চিরন্তন আমি'তে জেগে ওঠবার কথা আমরা পাই, আমাদার প্রাচ্যকবিও যে সেই আদর্শেই প্রভাবিত সেই কথা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেয় গীতাঞ্জলি। তাই রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন -

"রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে
তোমায় আমায় দেখা হল সেই মোহনার ধারে।"

আমাদের মনে আসে ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের কবিতা -

"Gently did my soul
Put off her veil and self-transmuted stood
Naked, as in the presence of god"

দান্তে একদা বলেছিলেন - "পৃথিবীর দুই প্রান্তের অচেনা দুই কবি মাঝে মাঝে মুখোমুখি কথা বলেন। আমরা চেয়ে দেখি এক অদ্ভুত সমভূমিতায় উপনীত হয় প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের আত্মসন্ধান। আর গীতাঞ্জলিকে বুঝতে গেলে চাইতে হয় রবীন্দ্রনাথের আজীবন উপনিষদ চর্চার পানে।" এর কেন্দ্রে আছে হেমন্তবালা দেবীকে লেখা চিঠির এই ক'টা কথা - "উপনিষদ মানুষের আত্মার মধ্যে পরমাত্মার সন্ধান দেয়।" শঙ্খ ঘোষের মতে গীতাঞ্জলি 'চিরায়ত ঐতিহ্যের কবিতা।'

আমি'র আবরণ মোচনের বা নিজেকে গড়ে তোলার এই যে সাধনা গীতাঞ্জলি থেকে গীতালিতে তা মূলতঃ এক সূত্রে গাঁথা হলেও কোথায় যেন একটা 'সূক্ষ্ম স্তর পেরিয়ে আসার ছাপ খুঁজে পাই এই উত্তোরণের গানগুলিতে। গীতাঞ্জলিতে রয়েছে এক বেদনা, দৈনন্দিন গ্লানিময় সেই ভাঙা-ছেঁড়া আমি'কে নিজের মধ্যে বয়ে বেড়ানোর বেদনা, পাস্কালের ভাষায়, 'আমি'-ময় ছদ্মপোশাক"টি দিয়ে নিজেকে ঘিরে রাখবার বেদনা -

"আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে ॥"

গীতালিতে এসে রবীন্দ্রনাথ নিজের মধ্যে অনুভব করলেন এক নতুন 'আমি'-কে, যে আমি প্রাত্যহিক তুচ্ছতার বহু ঊর্ধ্বে। নিজের ভেতর এই দুই আমিকে জাগিয়ে তোলার যে খেলায় গীতালিতে মাতলেন রবীন্দ্রনাথ, তারই সমান্তরালভাবেই যেন ভেসে আসে কয়েক বছর বাদে লেখা একটি গানের এই কথাগুলো –

"ওযে সদাই বাইরে আছে, দুঃখে সুখে নিত্যনাচে
ঢেউ দিয়ে যায়, দোলে যে ঢেউ খেয়ে।
একটু ক্ষয়ে ক্ষতি লাগে, একটু ঘায়ে ক্ষত জাগে
ওরই পানে দেখেছি আমি চেয়ে ॥
... ... ...
এই যে আমি ওই আমি নই
আপন মাঝে আপনি যে রই
যাই নে ভেসে মরণ ধারা বেয়ে
মুক্ত আমি তৃপ্ত আমি, শান্ত আমি দীপ্ত আমি
ওরই পানে দেখেছি আমি চেয়ে ॥
তোমার খোঁজা শেষ হবেনা মোর"

রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা-কেন্দ্রিক যাবতীয় প্রশ্নের অন্তিম উত্তর বোধহয় এই। নিজের নিগূঢতম আমি'কে উদয়াচল হাতড়ে বেড়াবার যে সত্য ব্যক্ত হতে দেখেছিলাম 'চিত্রা'-র যুগে, উত্তরযুগের অসংখ্য গানে কবিতায় তাকেই পেয়েছি বারেবারে নানা ভঙ্গিতে। গীতাঞ্জলির এ কবিতাও সেই সত্যকেই আরেকবার তুলে ধরে। এর পাশে অনায়াসেই রাখতে পারি টম্পসনের দেওয়া সেই রবীন্দ্র-ভাষ্যকে -"When the Jibandebata came to me, I felt overwhelming joy - it seemed a discovery new with me, in this deepest self-seeking expression. I wished to sink into it-to give myself up to it. Today I am on the same plane as my readers, I am trying to find what the Jibandebata was."

জীবনের দেবতাকে নিজের আলোয় চিনে নেওয়ার বা জীবনদেবতার আলোয় নিজেকে নিজের কাছে তুলে ধরার এই যে "ধ্যানরূপ সম্পূর্ণ হতে দেওয়ার সাধনা" এ ছিল রবীন্দ্রনাথের আজন্ম পরম সাধন। শেষ জীবনে 'Hibbert Lectures' এ নিজের ধর্ম সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দিতে গিয়েও তিনি এনেছেন জীবনদেবতার প্রসঙ্গ। তাঁর জীবনের সমস্ত চলা বসায় জড়িয়ে রয়েছে যে সত্তা তাকেই উদ্দেশ্য করেই পরিশেষে বলেছিলেন কবি -

"আমি ভাবি মনে মনে তাহারে কি চিনি
সুখে দুঃখে দিনে দিনে বিচিত্র যে আমার পরাণে।"

রচনাবলির ব্যাখ্যায় জীবনদেবতা প্রসঙ্গে কবির নিজের কথা পাই "আমার একটি যুগ্ম সত্তা - সে আমারই ব্যক্তিত্বের অন্তর্গত - তারই সংকল্প পূর্ণ হচ্ছে আমার মধ্য দিয়ে আমার সুখে দুঃখে আমার ভাল মন্দয়।" এর পাশে বিনা আয়াসেই আমরা ফুটিয়ে তুলতে পারি "গীতাঞ্জলির সেই আবেদনের সুর -

"তোমার ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবন মাঝে।"

গীতাঞ্জলি আসলে জীবনের দেবতার সঙ্গে নিজেদের মেলাতে চাওয়ার কাব্য। বুদ্ধদেব বসু একেবলেছিলেন এক পরম মিলনাকাঙ্ক্ষার কবিতা। নিঃসংশয়ে বলা যায় রবীন্দ্রচেতনায় অধ্যাত্মভাবনার দিগন্ত স্পর্শ করে থাকা গীতাঞ্জলির ভাবলোক "এক প্রভুময় ভবন"।

তবু শেষ পর্যন্ত, কোথায় যেন এ কাব্যরবীন্দ্রনাথের আত্মজিজ্ঞাসার এক অন্য জগতকে তুলে ধরে আমাদের চোখে। সেই যে অজিতকুমার চক্রবর্তীকে একদা চিঠেতে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, "আমার মধ্যে এমন আমি আছে, যে আমার চেয়ে বড়ো, আমার মধ্যে তাকে কুলোবে কী করে"। গীতাঞ্জলি যেন সেই 'বড়ো আমি'-কেই খুঁজে নেওয়ার গান। যে পরমতার ছায়া গীতাঞ্জলির প্রতিটি পংক্তিকে অভিষিক্ত করে রেখেছে। তার বিশ্লেষণ কোন প্রথাগত ধর্মীয়তার গণ্ডীতে করা যায় না। সে অনুভুতির ছোঁয়া মেলে প্রাত্যহিক দিনযাপনের নিভৃত অবসরে নিজের সঙ্গে আমাদের মুখোমুখি মেলাবার মুহূর্তটিতে। নিজেকে এক অন্যতর সমগ্রতার মধ্যে জাগিয়ে তোলার গান গীতাঞ্জলি। নিজেকে নিজের মধ্যে ছোটো করে রাখা নয়, নিজেকে সবের মধ্যে এক করে দেখতে পারার মধ্যেই আমাদের মুক্তি।

"আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,
দুঃখবিপদ তুচ্ছ করা কঠিন কাজে।
বিশ্বধাতার যজ্ঞশালা আত্মহোমের বহ্নি জ্বালা
জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি-আশে।"

এরই সমান্তরাল যেন ধ্বণিত হতে দেখি জীবনের উপান্তবেলায় পৌঁছে মংপুতে মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে বলা সেই কথাগূলো – "আমি কোন দেবতা সৃষ্টি করে প্রার্থনা করতে পারিনে"। নিজের কাছ থেকে নিজের যে মুক্তি সেই দুর্লভ মুক্তি পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই বিশ্বজোড়া আনন্দের যজ্ঞশালায় দাঁড়িয়ে ব্যক্তিগত দুঃখশোক কী সহজ হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে -

"তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার
বাজাই আমি বাঁশি
গানে গানে গেঁথে বেড়াই 
প্রাণের কান্না-হাসি।"

পুত্রবিয়োগের ক্ষত মুখে কী সহজে জেগেছিল সুর –

"প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে
প্লাবিত করিয়া নিখিল দ্যুলোকে ভূলোকে
তোমার অমল অমৃত পড়িছে ঝরিয়া।"

গীতাঞ্জলির এই আত্মোপলব্ধির গানই যেন কোথায় এসে সমে মিলে যায় গীতালির সুরে -

"সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি
দুঃখে তোমায় পেয়েছি প্রাণ ভ'রে।"

আদ্যন্ত ঐশ্বরিকতায় আচ্ছন্ন রবীন্দ্রনাথে গীতাঞ্জলি তার আত্মজিজ্ঞাসার ধারাবাহিকতায় একটা খণ্ডযুগ, এ কথা আমরা বলতেই পারি। এ জিজ্ঞাসার প্রবাহ চলেছে রূপ থেকে রূপান্তরে (এক অনন্ত সম্ভাবনার চিহ্ন বুকে নিয়ে)। গীতাঞ্জলির যে গানে বলেছিলেন –

"কবে আমি বাহির হলেম 
তোমারি গান গেয়ে
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।"

তারই সূত্র ধরে আমরা যেন পেয়ে যাই তার আত্ম-অনুসন্ধানের চিরকালের সত্য –

"আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না
আমার ফুরাবে না॥"

………… সমাপ্ত …………

তথ্যপঞ্জীঃ
১. রবীন্দ্রনাথ: শ্রী সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত
২. রবীন্দ্রকাব্যের পুনর্বিচার: শ্রী শুভ্রাংশু ভূষণ মুখোপাধ্যায়
৩. রবীন্দ্রনাথ: শ্রী সুপ্রিয় ঠাকুর
৪. রবীন্দ্র জীবনী (১,২): শ্রী প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়
৫. এ আমির আবরণ: শ্রী শঙ্খ ঘোষ
৬. নির্মাণ ও সৃষ্টি: শ্রী শঙ্খ ঘোষ
৭. গীতাঞ্জলি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৮. গীতবিতান: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৯. সঞ্চয়িতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১০. মংপুতে রবীন্দ্রনাথ: মৈত্রেয়ী দেবী
১১. কাব্য পরিক্রমা: অজিত কুমার চক্রবর্তী
১২. আত্ম পরিচয়: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৩. রবীন্দ্রনাথ এনড্রুজ পত্রাবলি : মলিনা রায়
১৪. রবীন্দ্র প্রসঙ্গ: তথ্য সংস্কৃতি বিভাগ, পঃবঃ সরকার
১৫. রবীন্দ্রনাথ ও নোবেল পুরস্কার: সংকলন ও সম্পাদনা – বিজিতকুমার দত্ত, সমকালীন তথ্য
১৬. The God of Rabindranath Tagore: Jose Chunkapura
১৭. The Chief Currents of Contemporary Philosophy: D.M. Dutta

রবীন্দ্রনাথ ও গীতাঞ্জলিঃ আত্ম-জিজ্ঞাসার অন্য জগৎ

Column Published - Index

Forum

Geetabitan.com Forum.

Visit page

Collection of Tagore songs

By Geetabitan.com listed singers.

Visit page

Geetabitan.com singers list

Singers name, profile, photo and songs.

Visit page

Send us your recordings

To publish your song in this site.

Visit page

Collection of Chorus

By groups and institutions.

Visit page